রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:২২ অপরাহ্ন
ড. কামরুল হাসান মামুন :
একটু পেছনে তাকাই, কী ঘটছে গত তিন মাস ধরে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘটনার সূত্রপাত অধিভুক্ত সাত কলেজ নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের যথেষ্ট মান উন্নয়নে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ভার বহন করবে কী করে।
এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিল আন্দোলনে যোগ দিল বাম ছাত্র সংগঠনগুলো। এর মধ্যে শাহবাগ থানায় অজ্ঞাত পরিচয়ে মামলা, নিপীড়ন বিরোধীদের ওপর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের আকস্মিক হামলা, প্রক্টর প্রশাসনের পক্ষপাত ও বিমাতাসুলভ আচরণ হতাশ করেছিল শিক্ষার্থীসহ সবাইকে।
এবার আসি মূল ঘটনায়। গত ২৫ জানুয়ারি একদল ছাত্রছাত্রী নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে মাননীয় ভিসির অফিসে যায়। সংবাদ পেয়ে কলাপসিবল গেটে তালা মারা হয়। আন্দোলনরত ছেলেমেয়েরা তালা দেখে ক্ষেপে যায়, তালা ভেঙে ফেলে এবং মাননীয় ভিসির কাছে দাবি জানাতে গিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে। মাননীয় ভিসি এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তার দলীয় ছাত্রনেতাদের ডাকেন। ডাক পেয়ে ছাত্রনেতারা এসে যা করল তা করুণ ইতিহাস।
আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওতে দেখেছি। ফেসবুকে এ নিয়ে চলছে ক্ষোভের ঝড়। এর প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতি মানববন্ধনের ডাক দেয়। সেই ডাকের ভাষা নিম্নরূপ- ‘আজ ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ সাল অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির এক জরুরি সভায় প্রশাসনিক ভবনে ভাঙচুর, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদের ক্ষতিসাধন, মাননীয় উপাচার্যের সঙ্গে অশালীন আচরণের প্রতিবাদে আগামী ২৮ জানুয়ারি এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সম্মানিত শিক্ষককে মানববন্ধন কর্মসূচিতে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’
দুঃখের বিষয় হলো এই চিঠিতে মাননীয় উপাচার্যের ডাকে সারা দিয়ে একদল ছাত্র যে আরেকদল ছাত্রের ওপর হামলে পড়েছিল সেই কথার কোনো উল্লেখ নেই। আন্দোলনকারীরা তো তালা ভেঙেছে। কিন্তু পরে যারা এসেছিল তারা কিভাবে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের অমানবিকভাবে মেরে আহত করেছিল তার ভিডিও চিত্র দেখে আমার কান্না পেয়েছে। ছাত্র হয়ে ছাত্রের ওপর এমন অমানবিক কিভাবে হয়? ওই ছাত্রদের বাবা-মা কি তাদের সন্তানদের এমনভাবে মার খাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি কিভাবে এমন ন্যক্কারজনকভাবে একটি পক্ষ নেয়? যা সত্যি লজ্জাজনক। সেদিনের ছবি বা টেলিভিশনে সংবাদ দেখে একটুও কী উপলব্ধি করতে পারেননি আসল ঘটনার? এই জন্যই আমি সবসময় বলি শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতি করা উচিত নয়। আমাদের বেতন আসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। আমাদের বেতন দেয়া হয় পড়াশোনা করতে, পড়াশোনা করাতে আর গবেষণা করতে। দলবাজি আর চাপাবাজি করার জন্য জনগণের টাকায় বেতন পাই না। এইভাবে রাজনীতি করলে আমরা এমন অন্ধ হয়ে যাই। আমাদের পথ দেখাবে কে? পথপ্রদর্শকই যে পথ আজ হারিয়ে ফেলেছে। চোখ কান খুলে তাকিয়ে দেখুন তো। কষ্ট করতে হবে না। সবই তো এখন আমাদের আঙুলের ডগায়। একটু ইন্টারনেট ব্রাউজ করলেই দেখতে পাব সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কি করেন। কিছুদিন আগে চীনে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। দেখে এসেছি ওখানকার ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি জ্ঞান সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। এদিকে চীনের সরকার একটা যুগান্তকারী প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। প্রজেক্টের নাম হলো ‘1000 Talents Hunt Program’! এই প্রজেক্টের মাধ্যমে ৫৫ বছরের নিচে Chinese অরিজিন কেউ যদি খুব ট্যালেন্টেড এবং বিদেশে কোনো গবেষণা ইনস্টিটিউটে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে দেশ গড়ার কাজে ব্যবহার করা।
যারা এই ক্যাটাগরিতে নিয়োগ পাবে তাদের বিশেষ সম্মাননাস্বরূপ বলা হবে “National Distinguished Experts”! দেশে ফিরে গেলে তাদেরকে (১) Enabling working conditions এবং (২) Special living benefits দেয়া হবে। অর্থাৎ তারা বুঝতে পেরেছে যে ওরকম ট্যালেন্টেড মানুষগুলো দেশে ফিরে গেলেই হবে না তাদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। আমার প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম এক ছাত্র সাব্বির সুফিয়ান সম্প্রতি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে। যা খুবই মূল্যবান অনুধাবন। সে বর্তমানে আমেরিকায় পিএইচডি শেষে পোস্ট-ডক করছে। স্ট্যাটাসে সে লিখেছে, ‘আমার একজন কোলাবোরেটর প্রফেসর স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ডে অনেকদিন কাজ করে স্ট্যানফোর্ড এ স্থায়ী চাকরির প্রস্তাব ছেড়ে নিজের দেশ কোস্টারিকাতে ফিরে যান। ওখানে যাওয়ার পর ৩ বছরের জন্য সরকার তাকে সাইন্স-টেকনোলজি মিনিস্টার করে। তিনি অনেকটা সময় কোস্টারিকার ন্যাশনাল রিসার্চ নেটওয়ার্কের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাকে কোস্টারিকার ‘ফাদার অব ইন্টারনেট’ বলা হয় এবং তিনি লাইট-ফ্রন্ট হলোগ্রাফিক QCD-র জনক। সে আরো লিখেছে ‘ভাগ্য ভালো এই মানুষের জন্ম বাংলাদেশে না, এত যোগ্যতা নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে গেলে উনি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেতেন?’ বাংলাদেশি অরিজিন বিদেশে কর্মরত সেরা পদার্থবিদ এখন সম্ভবত জাহিদ হাসান। আমি ভাবছিলাম সে যদি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ফিরে আসে তার কি হবে? সে যদি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে চায় তাকে এখন প্রমাণ করতে হবে তার রাজনৈতিক চেতনা ঠিক আছে কি না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে এক চেতনা আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আরেক চেতনা। আবার চাকরি পেলেও বেতন দেয়া হবে গড়ের মাল হিসিবে। অর্থাৎ বিশেষ যোগ্য মানুষদের জন্য যে বিশেষ ব্যতিক্রম করা যায় এইটা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। সবাইকে এক পাল্লায় মাপা আমাদের মজ্জাগত অভ্যাস। খারাপ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ফলানোতে আমরা ওস্তাদ জাতি। ভালো ক্ষেত্রে নয়। আমাদের এক ছাত্র আমাকে প্রায়ই আমেরিকা থেকে মেসেজ পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করত ‘স্যার দেশে আসব কিনা একটু যদি ব্যাখ্যা করে জানাতেন’! সে এসেছে। তার পিএইচডি আছে এবং পিএইচডির পর ইন্ডাস্ট্রিতে গবেষণার অভিজ্ঞতা আছে।
এ রকম আরো দুয়েকজন আছে যাদের পিএইচডি, পোস্ট-ডক ছিল কিন্তু তাদেরকে দেয়া হয়েছে প্রভাষক পদ। অর্থাৎ একজন সদ্য এমএসসি পাসও নিয়োগ পায় প্রভাষক পদে আবার ওরকম পিএইচডি প্লাস পোস্ট-ডক করার পরও তাকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়? Something is seriously wrong with the people in the selection board! প্রথম কথা হলো শুধু এমএসসি পাস কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগদান বন্ধ করা উচিত। অন্তত চেষ্টা করা উচিত। এমএসসি পাস কাউকে নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ওই ব্যক্তি দুইয়েরই অনেক ক্ষতি। তাকে নিয়োগ দিয়ে প্রবেশনারি পিরিয়ডের নামে শিগগির পিএইচডি করতে ছুটি দেয়া হবে না অথচ তখনই পিএইচডি করতে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। এটা হলো তার ক্ষতি। আর ইনস্টিটিউটের ক্ষতি এই জন্য যে তাকে বেতনসহ ছুটি দিতে হয়। এই ছুটিতে যাওয়ার একটি অংশ ফিরে আসে না আবার তাদের দেয়া বেতন ফিরে পেতে অনেক সময় মামলা মোকদ্দমায় যেতে হয়। এ ছাড়া ওই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয় তার সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হয়। তাই এইসব মাথায় রেখে যার পিএইচডি আছে এবং পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা আছে তাকে তো যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে নিয়োগ দেওয়া উচিত। এই দেশের ইনস্টিটিউটগুলোর প্রধান হিসেবে যারা আছেন তারা এইসব বিষয় ভাবার মতো সময়ও পান না। পাবেন কিভাবে দিবসের প্রায় পুরোটা সময় ব্যয় করেন দলবাজি আর চাপাবাজিতে! আমি স্পষ্ট করে আমার অবস্থান থেকে একটি কথা বলতে চাই, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যতদিন শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ না হবে ততদিন শিক্ষার মান, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মান কোনোদিনও ভালো হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কালের খবর/১৮/২/১৮